বিশ্বের সবচেয়ে বিরল রক্তের গ্রুপ:প্রতি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র একজনের শরীরে থাকে এই অনন্য রক্ত—কেন এত বিরল ও কেন এত মূল্যবান?

প্রতি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র একজনের শরীরে যে রক্তের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেটিই আরএইচ-নাল বা আরএইচ-বিহীন রক্ত। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত এই রক্তের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে মাত্র প্রায় ৫০ জন মানুষের শরীরে। বিরল হলেও মানবজীবন রক্ষায় এই রক্তের গুরুত্ব অপরিসীম। যাদের রক্তের গ্রুপ সাধারণ নিয়মে মেলানো যায় না, তাদের জীবন বাঁচাতে এই রক্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে—এমন আশায় বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এখন ল্যাবরেটরিতে এই রক্ত তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আধুনিক চিকিৎসায় রক্ত সঞ্চালনের বিপ্লব
রক্ত সঞ্চালন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম বড় সাফল্য। দুর্ঘটনা, প্রসবকালীন জটিলতা, ক্যানসার চিকিৎসা কিংবা বড় অস্ত্রোপচারে দান করা রক্ত অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। রক্তদানের মাধ্যমে একটি মানবিক সেতুবন্ধন তৈরি হয়, যেখানে একজনের দান অন্যজনের জীবন বাঁচায়। তবে এই সুবিধা সবার জন্য সমান নয়। রক্তের গ্রুপ মেলাতে না পারলে এই জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থাই কখনো কখনো ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রক্তের গ্রুপ না মিললে বিপদ:বিশ্বের সবচেয়ে বিরল রক্তের গ্রুপ
রোগীর রক্তের সঙ্গে উপযুক্ত ডোনারের রক্ত না মিললে শরীরে মারাত্মক ইমিউন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে যাদের রক্ত অত্যন্ত বিরল, তাদের জন্য নিরাপদ রক্ত পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আরএইচ-নাল রক্তধারীদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা যায়। তারা নিজেরা যেমন অন্যের রক্ত নিতে পারেন না, তেমনি নিজেরাও সব সময় উপযুক্ত রক্ত পাওয়ার নিশ্চয়তা পান না। এ কারণে চিকিৎসকেরা তাদের নিজেদের রক্ত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
কেন একে ‘গোল্ডেন ব্লাড’ বলা হয়
দুষ্প্রাপ্যতার পাশাপাশি বহুমুখী ব্যবহারযোগ্যতার কারণে আরএইচ-নাল রক্তকে চিকিৎসা ও গবেষণা মহলে ‘গোল্ডেন ব্লাড’ বা সোনালি রক্ত বলা হয়। এই রক্তে আরএইচ সিস্টেমের কোনো অ্যান্টিজেন না থাকায় অধিকাংশ মানুষের শরীরেই এটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। জরুরি পরিস্থিতিতে, যখন রোগীর রক্তের ধরন নির্ণয়ের সময় থাকে না, তখন এই রক্ত জীবনরক্ষাকারী বিকল্প হতে পারে।
অ্যান্টিজেন ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার ভূমিকা
মানুষের রক্তের ধরন নির্ধারিত হয় লাল রক্তকণিকার উপরিভাগে থাকা অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ওপর। অ্যান্টিজেন মূলত প্রোটিন বা শর্করার গঠন, যেগুলো শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা শনাক্ত করতে পারে। ভিন্ন অ্যান্টিজেনযুক্ত রক্ত শরীরে প্রবেশ করলে ইমিউন সিস্টেম অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেই রক্তকে আক্রমণ করে। ফলে জ্বর, কিডনি বিকল হওয়া এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
এবিও ও রেসাস (আরএইচ) সিস্টেম
রক্ত সঞ্চালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সিস্টেম হলো এবিও এবং রেসাস বা আরএইচ। এ গ্রুপের রক্তে এ অ্যান্টিজেন, বি গ্রুপে বি অ্যান্টিজেন, এবি গ্রুপে উভয় অ্যান্টিজেন এবং ও গ্রুপে কোনো অ্যান্টিজেন থাকে না। প্রতিটি গ্রুপ আবার আরএইচ পজিটিভ বা আরএইচ নেগেটিভ হতে পারে। সাধারণভাবে ও নেগেটিভকে সার্বজনীন রক্তদাতা বলা হলেও বাস্তবে বিষয়টি এত সহজ নয়।
রক্তের বৈচিত্র্য ও জটিল বাস্তবতা
২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ৪৭টি স্বীকৃত রক্তের গ্রুপ এবং ৩৬৬টির বেশি অ্যান্টিজেন শনাক্ত করেছেন। এর মানে হলো, ও নেগেটিভ রক্ত গ্রহণ করলেও অন্যান্য অ্যান্টিজেনের কারণে শরীরে প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আরএইচ সিস্টেমেই রয়েছে ৫০টির বেশি অ্যান্টিজেন। কিন্তু আরএইচ-নাল রক্তধারীদের শরীরে এই ৫০টির একটিও নেই, যা এই রক্তকে একই সঙ্গে অমূল্য ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
আরএইচ-নাল রক্তের জিনগত উৎপত্তি
সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, আরএইচ-নাল রক্তের উৎপত্তি ঘটে একটি বিরল জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে। এই পরিবর্তন আরএইচ অ্যাসোসিয়েটেড গ্লাইকোপ্রোটিন (আরএইচএজি) নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনকে প্রভাবিত করে। এই প্রোটিন লাল রক্তকণিকার গঠন ও স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জিনগত মিউটেশনের ফলে অন্যান্য আরএইচ অ্যান্টিজেনের প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
ল্যাবরেটরিতে রক্ত তৈরির বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি

২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা প্রথমবারের মতো ল্যাবরেটরিতে আরএইচ-নাল রক্তের অনুকরণ তৈরি করতে সক্ষম হন। তারা অবিকশিত লাল রক্তকণিকা এবং সিআরআইএসপিআর-সিএএস৯ জিন এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবিও ও আরএইচসহ পাঁচটি প্রধান রক্তের গ্রুপের অ্যান্টিজেন নিষ্ক্রিয় করেন। এর ফলে এমন রক্ত তৈরি হয়, যা সাধারণ ও বিরল—উভয় ধরনের রক্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
স্টেম সেল গবেষণা ও বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানীরা স্টেম সেল ব্যবহার করে কৃত্রিম রক্ত তৈরির গবেষণা চালাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে হিউম্যান ইনডিউজড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল থেকে কাস্টমাইজড বিরল রক্ত তৈরির পরীক্ষা হয়েছে। কানাডায় এ পজিটিভ দাতার স্টেম সেল থেকে ও আরএইচ-নাল রক্ত তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্পেনে একজন আরএইচ-নাল দাতার রক্তকে আরও সার্বজনীন করার পরীক্ষাও চালানো হয়েছে।
কেন এখনো ক্লিনিক্যাল ব্যবহারে আসেনি
এত অগ্রগতি সত্ত্বেও ল্যাব-উৎপাদিত রক্ত এখনো ব্যাপক ব্যবহারের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বিপুল পরিমাণে লাল রক্তকণিকা উৎপাদন করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। মানবদেহে হাড়ের মজ্জা যেভাবে জটিল সংকেতের মাধ্যমে রক্ত তৈরি করে, ল্যাবরেটরিতে সেই প্রক্রিয়া অনুকরণ করা অত্যন্ত কঠিন। এছাড়া জিন এডিটিং প্রযুক্তি অনেক দেশে নৈতিক ও আইনি কারণে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও ভবিষ্যৎ আশা
বর্তমানে বিশ্বের প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দাতার স্টেম সেল থেকে উৎপাদিত লাল রক্তকণিকা স্বেচ্ছাসেবীদের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হচ্ছে। এই রক্তে কোনো জিন এডিটিং করা হয়নি, তবুও এখানে পৌঁছাতে বিজ্ঞানীদের প্রায় এক দশক গবেষণা করতে হয়েছে। গবেষকদের আশা, ভবিষ্যতে বিরল রক্তের গ্রুপের মানুষের জন্য বিশেষ রক্তব্যাংক তৈরি করা সম্ভব হবে।
উপসংহার
বর্তমান বাস্তবতায় সরাসরি রক্তদানই সবচেয়ে কার্যকর ও সাশ্রয়ী উপায়। তবে আরএইচ-নাল বা ‘সোনালি রক্ত’ নিয়ে চলমান গবেষণা মানবসভ্যতার জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। ভবিষ্যতে যদি এই প্রযুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রক্তের অভাবে কোনো জীবন ঝরে পড়বে না—এই আশাই দেখছেন বিজ্ঞানীরা।