কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস কোনটি ?

কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস বাঁধন হারা, মৃত্যুক্ষুধা ও কুহেলিকার কাহিনি, প্রকাশকাল ও সাহিত্যিক গুরুত্ব  জানুন এক পোস্টে।

কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস কোনটি?

(ক) ঝিলিমিলি

(খ) আলেয়া

(গ) মৃত্যুক্ষুধা

(ঘ) মধুমালা

বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু কবি নন, তিনি ছিলেন একজন শক্তিমান উপন্যাসিকও। তাঁর উপন্যাসে সমাজ, রাজনীতি, দারিদ্র্য, মানবতা এবং প্রেম—সবকিছুরই বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়। নজরুলের রচিত তিনটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলোকাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস: বাঁধন হারা, মৃত্যুক্ষুধা ও কুহেলিকা

১.বাঁধন হারা:

‘বাঁধন-হারা’ উপন্যাসে মোট দশটি চরিত্র রয়েছে—নুরুল হুদা, মাহবুবা, রাবেয়া, সাহসিকা, আয়েশা, খুকি আনারকলি, মা রোকেয়া, মনুয়ার, রবিউল এবং সোফিয়া। রাবেয়া ও রবিউল দম্পতির শিশুকন্যা খুকি বা আনারকলি ছাড়া বাকি সব চরিত্রই নিজেদের চিঠির মাধ্যমে কাহিনি ও ভাবনা প্রকাশ করে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে নজরুল বাঙালিদের প্রথম আধুনিক যুদ্ধ-অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। এতে তাঁর সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতার স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়।

কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঁধন-হারা’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস। করাচিতে থাকাকালীন তিনি এই উপন্যাস রচনা শুরু করেন। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে ‘বাঁধন-হারা’ বই আকারে প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশ করে ডি. এম. লাইব্রেরি এবং বইটির মূল্য নির্ধারণ করা হয় দুই টাকা।

২.মৃত্যুক্ষুধা:

‘মৃত্যুক্ষুধা’ কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি বহুল আলোচিত ও গভীর মানবিক উপন্যাস। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে এটি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। এর আগে উপন্যাসটি ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ থেকে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘সওগাত’ পত্রিকায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাসে নজরুল মানবজীবনের চরম দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও সামাজিক বৈষম্যকে অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসটি শুরু হয় এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারের হৃদয়বিদারক গল্প দিয়ে। সেই পরিবারে রয়েছে রোগশয্যায় কাতর এক বৃদ্ধ মা, তিনজন বিধবা পুত্রবধূ এবং তাদের দেবর প্যাঁকালে। নজরুল উপন্যাসটিতে প্যাঁকালে ও আনসার চরিত্রের মাধ্যমে নিজের দ্বৈতসত্তা ও মানবিক দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মেজ বউ রুবি চরিত্রটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যার মাধ্যমে নারীজীবনের সংগ্রাম ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নটি অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে ফুটে উঠেছে।

দারিদ্র্য ও ক্ষুধার তাড়নায় পরিবারের সদস্যরা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। অন্যদিকে, বেঁচে থাকার তাগিদে মেজ বউ–রুবিকে বেছে নিতে হয় যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন জীবন। অথচ শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরে আসতে হয় সেই চিরচেনা বস্তিজীবনে। মিশনারিদের বহু অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি আর ধর্মান্তরিত জীবনে ফিরে যাননি, আবার মুসলমানেও পরিণত হননি—নিজ অবস্থানেই দৃঢ় থেকেছেন।

‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে যুদ্ধোত্তর সমাজের শ্রেণিবৈষম্য, অর্থসংকট, নগরজীবনের নির্মমতা এবং দারিদ্র্যের কঠোর বাস্তবতা শক্তিশালীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে মানবিক সাম্য, বিপ্লবী চেতনা এবং জীবনসংগ্রামের গভীর অর্থ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

৩. কুহেলিকা:

‘কুহেলিকা’ কাজী নজরুল ইসলামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিকধর্মী উপন্যাস। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক নওরোজ পত্রিকায় উপন্যাসটির প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়। পরে নওরোজ বন্ধ হয়ে গেলে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে সওগাত পত্রিকায়। অবশেষে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে কুহেলিকা প্রথম বই আকারে প্রকাশ পায়। উপন্যাসটিতে নজরুল তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, স্বাধীনতার প্রতি অনুরাগ এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানসিকতার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিপ্লবী যুবক জাহাঙ্গীর—যার মাধ্যমে সমাজনীতি, রাজনীতি ও ধর্মনীতির সূক্ষ্ম ও গভীর বিশ্লেষণ ফুটে উঠেছে। কাহিনি সমসাময়িক সময়কে ভিত্তি করে রচিত হলেও নজরুল তা নির্মাণ করেছেন নিজের স্বতন্ত্র শৈলীতে। ব্যঙ্গ, হাস্যরস, আবেগ এবং মিথ–কথনের মনোমুগ্ধকর সমন্বয় উপন্যাসটিকে করেছে বিশেষ আকর্ষণীয়।

জাহাঙ্গীরের জন্ম–সংক্রান্ত বিদ্রোহী বর্ণনা, বন্ধু হারুনের সঙ্গে তার বাড়ির পথে যাত্রা, হারুনের পাগলী মায়ের অদ্ভুত আচরণ, অন্ধ পিতা, খোন্দকার সাহেব এবং তাঁর দুই কন্যার চরিত্র—সবকিছুই পাঠককে গভীরভাবে ভাবায়। উপন্যাসের সংলাপগুলো মনস্তত্ত্বে ভরপুর, যা চরিত্রদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সামাজিক বাস্তবতাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।

সব মিলিয়ে, ‘কুহেলিকা’ কেবল একটি রাজনৈতিক উপন্যাস নয়; এটি স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত মানুষের সংগ্রাম, সামাজিক বৈষম্য, নিম্নবিত্ত বাঙালির বাস্তব জীবনযাপন এবং মানবিক চেতনার এক অনন্য শিল্পরূপ। এর কাহিনি পাঠকের মনে জাগায় অন্যরকম অনুভূতি ও চিন্তার আলোড়ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *